গাছের পাতা খেয়ে নিচ্ছে পোকা? রান্নাঘরের এই ৫টি জিনিস দিয়েই বানান শক্তিশালী জৈব কীটনাশক

Published On:
শক্তিশালী জৈব কীটনাশক

আগের দুটো পোস্টে আমরা আমাদের বাগানের মাটি আর গাছের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের কথা জেনেছি। কেঁচো সার যেমন ধীরে ধীরে মাটিকে উর্বর করে তোলে, তেমনই ঘরে তৈরি তরল সার গাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

কিন্তু বর্ষাকাল এলেই যেন এক নতুন বিপদ এসে হাজির হয় – গাছের পাতায় কিলবিল করে পোকা, আর পাতায় পাতায় দেখা যায় ছত্রাকের আক্রমণ। অনেক যত্ন করার পরেও যদি দেখেন আপনার সবুজ গাছ পোকামাকড়ের দখলে চলে যাচ্ছে, তাহলে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক।

তবে চিন্তা নেই! আজ আমি আপনাদের শেখাবো কীভাবে আপনার রান্নাঘরের কয়েকটি সাধারণ জিনিস ব্যবহার করেই শক্তিশালী জৈব কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক তৈরি করতে পারবেন। আর সবচেয়ে ভালো কথা হলো, এগুলো আপনার গাছের জন্য তো বটেই, আমাদের পরিবেশের জন্যও সম্পূর্ণ নিরাপদ।

কেন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করবেন না?

একটু ভেবে দেখুন, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করার পর কী হয়? তারা হয়তো আপনার গাছের ক্ষতিকর পোকাদের মেরে ফেলে, কিন্তু একই সাথে মাটিতে থাকা উপকারী জীবাণু এবং মৌমাছি, প্রজাপতির মতো বন্ধু পোকাদেরও ক্ষতি করে। শুধু তাই নয়, যারা নিয়মিত সবজি বাগান করেন, তাদের জন্য রাসায়নিক স্প্রে করা সবজির মাধ্যমে আমাদের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। তাই না?

আসুন, আমরা প্রকৃতির নিয়মেই আমাদের গাছকে রক্ষা করি।

আমার বাগানের সেরা ৫টি জৈব অস্ত্র

বর্ষাকালে পোকামাকড়ের উপদ্রব একটু বেশিই থাকে। তাই এই সময় আপনার বাগানের জন্য চাই কিছু শক্তিশালী অথচ প্রাকৃতিক সমাধান। নিচে ৫টি এমন ঘরোয়া উপায় দেওয়া হলো:

১. নিম তেল: জৈব বাগানের ব্রহ্মাস্ত্র

নিম তেল হলো প্রকৃতি প্রদত্ত এক অসাধারণ কীটনাশক। এর গন্ধ এবং উপাদান পোকামাকড়ের ডিম পাড়া এবং বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

  • কীভাবে কাজ করে: নিম তেলে থাকা অ্যাজাডাইরেকটিন (Azadirachtin) নামক উপাদান পোকামাকড়ের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, ফলে তারা আর বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।
  • বানানোর পদ্ধতি: ১ লিটার পরিষ্কার জলের সাথে ১ চা চামচ খাঁটি নিম তেল এবং আধা চা চামচ যেকোনো লিকুইড সোপ (শ্যাম্পু বা হ্যান্ডওয়াশ) খুব ভালো করে মিশিয়ে নিন। ঝাঁকাতে থাকুন যতক্ষণ না তেল জলের সাথে ভালোভাবে মিশে যায়।
  • কোন শত্রুর বিরুদ্ধে: জাব পোকা (aphids), মিলিবাগ, সাদা মাছি, থ্রিপস, মাকড়সা মাইট এবং আরও অনেক ধরনের চোষা পোকা ও পাতা খাওয়া পোকা।
  • ব্যবহার বিধি: আক্রান্ত গাছে ২-৩ দিন অন্তর স্প্রে করুন।

২. তরল সাবানের স্প্রে: নরম শরীরযুক্ত পোকার যম

সাধারণ লিকুইড সোপ বা তরল সাবান নরম শরীরযুক্ত পোকামাকড়ের জন্য খুব কার্যকর।

  • কীভাবে কাজ করে: সাবান পোকার শরীরের বাইরের নরম আবরণ নষ্ট করে দেয়, যার ফলে তাদের শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় এবং তারা মারা যায়।
  • বানানোর পদ্ধতি: ১ লিটার জলে ১ চা চামচ লিকুইড সোপ (ডিটারজেন্ট মেশানো সাবান এড়িয়ে চলুন) ভালো করে মিশিয়ে নিন।
  • কোন শত্রুর বিরুদ্ধে: জাব পোকা (aphids), সাদা মাছি এবং ছোট আকারের নরম শরীরযুক্ত পোকা।
  • ব্যবহার বিধি: সরাসরি পোকার উপর স্প্রে করুন। সকালে বা সন্ধ্যায় স্প্রে করা ভালো।

৩. রসুন-লঙ্কার স্প্রে: ঝাঁঝালো গন্ধে পালাবে কীট

রসুন এবং লঙ্কার তীব্র গন্ধ অনেক পোকামাকড়ের অপছন্দ। এই স্প্রে ব্যবহার করলে তারা গাছের কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।

  • কীভাবে কাজ করে: রসুনে থাকা অ্যালিসিন এবং লঙ্কার ক্যাপসাইসিন পোকাদের বিরক্তি সৃষ্টি করে এবং তাদের দূরে রাখে।
  • বানানোর পদ্ধতি: ৪-৫ কোয়া রসুন এবং ২-৩টি কাঁচালঙ্কা একসাথে থেঁতো করে বা বেটে নিন। একটি পাত্রে ১ লিটার জল নিয়ে তার মধ্যে এই মিশ্রণটি মিশিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে জলটা ছেঁকে নিয়ে স্প্রে বোতলে ভরে ব্যবহার করুন।
  • কোন শত্রুর বিরুদ্ধে: পিঁপড়ে, শুঁয়োপোকা, ছোট ছোট পাতা খাওয়া পোকা এবং অন্যান্য কীট।
  • ব্যবহার বিধি: সপ্তাহে একবার বা পোকার উপদ্রব বেশি হলে দুবার স্প্রে করতে পারেন।

৪. হলুদের জল: প্রাকৃতিক ছত্রাকনাশক

হলুদ শুধু রান্নার মশলাই নয়, এটি একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ছত্রাকনাশকও বটে।

  • কীভাবে কাজ করে: হলুদে থাকা কারকিউমিন (Curcumin) নামক যৌগটি ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে।
  • বানানোর পদ্ধতি: ১ লিটার জলে ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিন।
  • কোন শত্রুর বিরুদ্ধে: পাতার দাগ (leaf spot), পাউডারি মিলডিউ (powdery mildew) এবং অন্যান্য সাধারণ ছত্রাকজনিত রোগ। গাছের গোড়ায় ছত্রাকের সংক্রমণ হলে হলুদের পেস্ট বানিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দিতে পারেন।
  • ব্যবহার বিধি: আক্রান্ত পাতায় বা গাছের গোড়ায় স্প্রে করুন।

৫. বেকিং সোডার স্প্রে: ছত্রাকের আক্রমণ থেকে মুক্তি

বেকিং সোডা বা খাবার সোডাও একটি চমৎকার ঘরোয়া ছত্রাকনাশক হিসেবে কাজ করে।

  • কীভাবে কাজ করে: বেকিং সোডা পাতার উপরিভাগের pH-এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা অনেক ছত্রাকের বংশবৃদ্ধির জন্য প্রতিকূল।
  • বানানোর পদ্ধতি: ১ লিটার জলে ১ চা চামচ বেকিং সোডা এবং কয়েক ফোঁটা লিকুইড সোপ মিশিয়ে নিন। সাবান মেশালে স্প্রে ভালোভাবে পাতার উপর লেগে থাকে।
  • কোন শত্রুর বিরুদ্ধে: পাউডারি মিলডিউ (powdery mildew) এবং কালো দাগ (black spot)।
  • ব্যবহার বিধি: আক্রান্ত গাছে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করুন।

ব্যবহারের আগে মনে রাখবেন

যেকোনো স্প্রে ব্যবহারের আগে অল্প পরিমাণে কোনো একটি পাতায় স্প্রে করে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। যদি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখেন, তবেই পুরো গাছে ব্যবহার করুন। স্প্রে করার সময় পাতার উপরের ও নিচের দিকে ভালোভাবে স্প্রে করুন। সকালের ঠান্ডা আবহাওয়া অথবা সন্ধ্যার পরে স্প্রে করাই ভালো, কারণ দিনের বেলায় কড়া রোদ থাকলে পাতার ক্ষতি হতে পারে।

শেষ কথা

রাসায়নিক কীটনাশকের ভয়াল থাবা থেকে আমাদের গাছ এবং পরিবেশকে বাঁচাতে জৈব পদ্ধতির বিকল্প নেই। আপনার রান্নাঘরের সামান্য উপকরণ আর একটু সচেতনতাই পারে আপনার বাগানকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে।

আপনার বাগানে পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাতে আপনি আর কী কী ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করেন? আমাদের সাথে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই শেয়ার করুন। আপনার অভিজ্ঞতা অন্যদেরও সাহায্য করতে পারে।

Follow Us On

Leave a Comment

Krishimaya Launcher

Krishimaya

Make an organic environment